তীব্র জলজট ও দুঃসহ যানজটে নগরীর জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল মঙ্গলবার। সকাল থেকে টানা বৃষ্টিতে রাজধানীজুড়ে সৃষ্ট ভয়াবহ জলাবদ্ধতায় রাস্তায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে সব ধরনের যানবাহন। শ্রমজীবী ও কর্মজীবী মানুষসহ শিক্ষার্থীদের নাকানি-চুবানি খেতে হয়। ভেঙে পড়ে গোটা ট্রাফিক ব্যবস্থা। নগরীর অনেক এলাকা গভীর রাত পর্যন্ত পানির নিচে ডুবে ছিল। মধ্য ভাদ্রের এ ভারি বর্ষণে একদিকে জীবনযাত্রা যেমন ব্যাহত হয়েছে, তেমনি সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে নগরবাসীকে। দুই আড়াই ঘণ্টার বৃষ্টিতেই তলিয়ে যায় নগরীর অধিকাংশ এলাকা। পানিতে একাকার হয়ে প্রতিটি অলিগলি থৈথৈ করতে থাকে।
ঘর থেকে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে যারা বের হয়েছেন, মাঝ রাস্তায় তাদের পড়তে হয় চরম দুর্ভোগে। ভুক্তভোগীরা বলেছেন, ২-৩ ঘণ্টার বৃষ্টিতে যেভাবে পুরো ঢাকা ডুবে গেছে, তাতে এ শহর বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। তীব্র যানজটের কারণে ১ ঘণ্টা দূরত্বের রাস্তা পার হতে সময় লেগেছে ৩ থেকে ৫ ঘণ্টারও বেশি। সকালে অফিসের উদ্দেশে ঘর থেকে বের হয়ে দুপুরের আগে অধিকাংশ মানুষ অফিসে পৌঁছতে পারেননি। আবার ঘরে ফেরার পথেও পড়তে হয়েছে চরম ভোগান্তিতে। প্রবল বর্ষণের কারণে মঙ্গলবার সকালে স্কুলগামী শিক্ষার্থী আর অফিসগামীদের পড়তে হয় মারাত্মক বিড়ম্বনায়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে তাদের যানবাহন ধরতে হয়েছে। দুপুরে স্কুল ছুটির পর ধানমণ্ডি এলাকার স্কুলগুলোর আশপাশে দেখা গেছে হৃদয়বিদারক দৃশ্য। দীর্ঘসময় যানবাহন না পেয়ে স্কুলের শিক্ষার্থীরা ভয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে। ভারি ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বাধ্য হয়ে ওই সব শিশুদের দীর্ঘ রাস্তা পাড়ি দিতে হয়েছে। পশ্চিম ধানমণ্ডি মধুবাজারের তলিয়ে যাওয়া সড়কে খোলা ম্যানহলগুলো এ সময় এক ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি করে। অসংখ্য স্কুলের ছাত্রছাত্রী এসব খোলা ম্যানহলে পড়ে আহত হয়েছে। ধানমণ্ডি ২৭ নম্বর সড়কে কোমরপানিতে সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও বাস-মিনিবাস বন্ধ হয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকে। এতে রাস্তায় তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়। এক পর্যায়ে পুরো ঢাকা শহর স্থবির হয়ে পড়ে। যানবাহনের চাকা স্থির হয়ে যায়। এ সুযোগে রিকশা ও সিএনজি ভাড়াও কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেন চালকরা।
দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে কিছুটা কমে আসে আকাশের কান্না। এরপর রাস্তায় পাড়ে নগরবাসীর উপস্থিতি। এর মাঝে রাস্তায় জমে থাকা পানির কারণে সৃষ্টি হয় তীব্র যানজট। শাান্তিনগর, ধানমণ্ডি, মধুবাজার, কারওয়ান বাজার, কলাবাগান, সংসদ ভবন এলাকা, পুরো মিরপুর, শ্যামলী, আসাদগেট, হাজারীবাগ, ঝিগাতলা, নিউমার্কেট, শাহবাগ, মিরপুর রোড, কাঁটাবন, রামপুরা, মেরুল, বাড্ডা, অভিজাত গুলশান-বনানী এলাকার অনেক রাস্তাও হাঁটুপানির নিচে তলিয়ে যায়। এ কারণে সর্বত্র দেখা দেয় তীব্র যানজট। নগরীর প্রায় প্রতিটি সড়কে দেখা যায় একই চিত্র। শুধু নিচু এলাকা নয়, উঁচু এলাকাতেও পানি জমে থাকতে দেখা যায়। মিরপুর সড়কে একেকটি গাড়িকে ৪-৫ ঘণ্টা ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে।
৩ নম্বর সতর্ক সংকেত : সক্রিয় মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে মঙ্গলবার রাত থেকে প্রবল বর্ষণে ডুবে গেছে রাজধানী ও বন্দরনগরী চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলা। আবহাওয়া অধিদফতরের পরিচালক শাহ আলম জানান, সকাল থেকে ৪২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এ বৃষ্টি আরও এক সপ্তাহ চলবে বলেও তিনি জানান। উত্তর বঙ্গোপসাগরে গভীর সঞ্চালনশীল মেঘমালা তৈরি হওয়ায় চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরকে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্কতা সংকেত দেখিয়ে যেতে বলেছে আবহাওয়া অধিদফতর। এক সতর্কবার্তায় মঙ্গলবার বলা হয়, গভীর সঞ্চালনশীল মেঘমালার প্রভাবে উত্তর বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকা এবং সমুদ্র বন্দরের ওপর দিয়ে ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে। উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত উপকূলের কাছাকাছি এসে সাবধানে চলাচল করতে বলা হয়েছে।
তিন নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত মানে হল বন্দর ও বন্দরে নোঙর করা জাহাজগুলোর দুর্যোগকবলিত হওয়ার আশংকা রয়েছে। বন্দরে ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে এবং ঘূর্ণি বাতাসের টানা গতিবেগ ঘণ্টায় ৪০ থেকে ৫০ কিলোমিটার হতে পারে। তবে বরিশাল, পটুয়াখালী, নোয়াখালী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের অভ্যন্তরীণ নদী বন্দরগুলোকে ২ নম্বর সতর্ক সংকেত দেখাতে বলেছে আবহাওয়া বিভাগ।
রাজধানীতে দুর্ভোগ : এদিকে সরেজমিন রাজধানীর পুরান ঢাকার নাজিম উদ্দিন সড়ক, কাকরাইল, মৎস্য ভবন মোড়, শান্তিনগর, মিন্টো রোড, মগবাজার, রামপুরা শাহবাগ চত্বর, সায়েন্সল্যাব, ধানমণ্ডি ২৭ নম্বর, মধুবাজার, বাংলামোটর, ফার্মগেট, মহাখালী, মিরপুরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে রাত ৮টার পরও এসব এলাকার অনেক রাস্তায় হাঁটু পানি ছিল। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনের সড়ক, সংসদ ভবনের দক্ষিণের প্রবেশমুখ, মানিক মিয়া এভিনিউসহ গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন সড়কে পানি জমে দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি হয়। সেই সঙ্গে গাড়ির গতি কম থাকায় দীর্ঘ যানজটে নাকাল হতে হয় অফিস ফেরত চাকরিজীবীদের। মিরপুরে যানজটে আটকে পড়া অবস্থায় কথা হয় গার্মেন্ট কর্মকর্তা সাইদুজ্জামান পলাশের সঙ্গে। বৃষ্টিতে রাজধানীর এ চিত্রে ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি জানান, বাসা থকে বের হয়ে প্রায় পৌনে ৩ ঘণ্টা আটকে ছিলেন। চারদিকে পানি আর পানি। এই পানি নামার পথও নেই বলে তিনি জানান।
ধানমণ্ডি ১১/এ সড়কে দাঁড়িয়ে একজন অভিভাবক জানান, মিরপুর থেকে ধানমণ্ডির একটি স্কুলে আসতে তার প্রায় চার ঘণ্টা সময় লেগেছে। তিনি বলেন, নাতনি আরিশার স্কুল ছুটি হয়েছে বেলা দেড়টায়। তিনি স্কুলে পৌঁছেছেন ছুটির ১ ঘণ্টা পর। পুরো মিরপুর থেকে হেঁটে তিনি ধানমণ্ডির স্কুলে পৌঁছেছেন বলেও জানান।
বেলা সাড়ে ৩টায় মহাখালী ফ্লাইওভারের ওপর যানবাহনের দীর্ঘ জট দেখা যায়। সড়কের বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টির পানির সঙ্গে নর্দমার কাদা একাকার হয়ে হেঁটে গন্তব্যে পৌঁছানোর পথও কঠিন করে তোলে।
পুলিশের ট্রাফিক কন্ট্রোল রুম থেকে দুপুরে জানানো হয়, বৃষ্টির কারণে রাজধানীজুড়ে ভয়াবহ যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে মহাখালী, বিজয় সরণি, বাংলামোটর, ফার্মগেট, শাহবাগ, মগবাজার এলাকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সমস্যা হচ্ছে। রাস্তায় পানি জমে যাওয়ায় ভিআইপি সড়কগুলোতে সিএনজিচালিত বহু অটোরিকশার ইঞ্জিন বিকল হয়ে আটকে থাকতে দেখা গেছে। এসব বিকল বাহন যানজট আরও বাড়িয়ে দেয় বলে ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা জানান। জাতীয় প্রেস ক্লাব থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে মহাখালী আসার পথে হাইকোর্টের সামনে যানজটে আটকা পড়েন ডাক্তার ঝিকু। পরে টিএসসি হয়ে এগোনোর চেষ্টা করলেও ফের আটকে যান। এরপর তিনি আর গন্তব্যে না গিয়ে মিরপুর টোলারবাগ পর্যন্ত পুরো রাস্তা হেঁটে বাসায় ফিরে যান। মোহাম্মদপুরের নূরজাহান রোড ও আশপাশের প্রতিটি সড়কে যানজট ছিল সকাল থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত। এ এলাকার বাসিন্দা ফৌজিয়া নীলু বলেন, বিভিন্ন রোডের অনেক বাস-মিনিবাস এ এলাকার অলিগলিতে ঢুকে পড়ায় রাস্তায় আটকে পড়া মানুষের ভোগান্তি আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। মিন্টো রোডেও দীর্ঘসময় গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। অনেকে উল্টোপথে যাওয়ার চেষ্টা করায় ঝামেলা আরও বেড়েছে। বাংলামোটরে কর্মরত ট্রাফিক পুলিশের পরিদর্শক বজলুর রহমান বলেন, বৃষ্টির কারণেই এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ফার্মগেট বিজয় সরণি, সোনারগাঁও লিংক রোড, মানিক মিয়া এভিনিউর পশ্চিম পাশে পানি জমে রয়েছে। পানির কারণেই যানজট ছাড়ানো যাচ্ছে না। প্রবল বৃষ্টির মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনের সড়কেও পানি জমে যায়। কিছুক্ষণ পর ওই সড়কের পানি নেমে গেলেও যানজট থেকে যেতে দেখা গেছে। ফার্মগেট থেকে সার্ক ফোয়ারা পর্যন্ত সড়কটির দু’পাশে হাঁটুপানি দেখা গেছে। উত্তরা থেকে মহাখালী আসার পথে কাকলিতে এক ঘণ্টার বেশি সময় যানজটে আটকে থাকতে হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দা ওমর ফারুক।