সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ ৪০ লাখের বেশি মানুষকে বাস্তুচ্যুত করেছে। ঘরবাড়ি হারানো এই মানুষগুলো পার্শ্ববর্তী দেশ তুরস্ক, জর্ডান ও লেবাননে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। কেউ আবার সুন্দর জীবনের আশায় ইউরোপে যেতে গিয়ে ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে মারা যাচ্ছেন। শরণার্থী এই মানুষগুলোর বেঁচে থাকার আর্তির হৃদয়গ্রাহী ছবি প্রতিনিয়তই সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উঠে আসে।
এমন দৃশ্য অনেককেই কাঁদায় ঠিকই, কিন্তু এই শরণার্থী মানুষগুলোর জীবনে কতটা পরিবর্তন আসে? তবে সম্প্রতি এমনই এক ছবি বদলে দিয়েছে এক সিরীয় শরণার্থীর জীবন।
নরওয়ের ত্রাণকর্মী জিস্সুর সাইমানারসন গত সপ্তাহে টুইটারে এক সিরীয় শরণার্থীর ছবি প্রকাশ করেন। এতে দেখা যায়, কয়েক বছর বয়সী মেয়েকে কাঁধে নিয়ে লেবাননের রাজধানীয় বৈরুতের রাস্তায় কলম বিক্রি করছে ওই সিরীয়। দেবদূতের মতো শিশুটি বাবার কাঁধে ঘুমিয়ে পড়েছে। আর ওই ব্যক্তি কলম হাতে রাস্তার মধ্যে দাঁড়িয়ে, মুখের অভিব্যক্তিতে করুণ আহ্বান। কয়েকদিনের মধ্যেই ছয় হাজারের বেশি মানুষ ছবিটি ফলো করেন।
সাইমনারসন যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে বলেন, সিরীয় শরণার্থীটির মুখের অভিব্যক্তি ও হাতের কলম ধরে রাখা দেখলে মনে হয় যেন এই কয়েকটি কলমই তাঁর শেষ সম্বল।
টুইটারে ছবি পোস্ট করার কয়েকঘণ্টার মধ্যেই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনেক মানুষ ওই ব্যক্তিকে সহায়তা করতে চায়। কিন্তু সাইমনারসন ওই ব্যক্তির পরিচয় ও ঠিকানা জানতেন না। এমন কী ছবিটি কার তোলা তাও ছিল অজানা। এই ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেরই সহায়তা নেন সাইমনারসন । তিনি টুইটারে বাইপেনস হ্যাশট্যাগ (#BuyPens) ব্যবহার করে সিরীয় শরণার্থীটির খোঁজ শুরু করেন।
দুই দিন পর বৈরুতে থাকা সিরীয় শরণার্থীটি খোঁজ পান তিনি। ওই ব্যক্তির নাম আবদুল (৩৫)। সারা বিশ্বের মানুষ তাঁকে খুঁজছে জানতে পেরে অবাকই হন তিনি। আর ছবিতে থাকা আবদুলের চার বছরের মেয়ে রিমকে এবার জেগে থাকা অবস্থায়ই পাওয়া যায়। মেয়েটির সঙ্গে ছবি তোলে তাঁদের খুঁজে বের করা অপর ত্রাণকর্মী ক্যারল মালোউফ।
আবদুলের মুখ থেকে জানা যায় তাঁর জীবনের করুণ কাহিনী। সিরিয়ার অন্যতম অবরুদ্ধ এলাকা ইয়ারমোক থেকে এসেছে সে। গৃহযুদ্ধ শুরুর আগে একটি চকোলেট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী ছিলেন তিনি। যুদ্ধ শুরু হলে সন্তানদের নিয়ে তিনি বৈরুতে এসেছেন এবং শরণার্থী হিসেবে নিবন্ধিত হয়েছেন।
আবদুলের পরিবারকে সহায়তা হিসেবে পাঁচ হাজার মার্কিন ডলার সংগ্রহের জন্য টুইটারে আহ্বান জানান সাইমনারসন। এর মাত্র ৩০ মিনিটের মধ্যে উল্লেখিত অর্থ সংগ্রহ হয়ে যায়।
এর পর সাইমনারসনের টুইটারে লেখেন, ‘এতেই প্রমাণ হয় মানবতা এখনো হারিয়ে যায়নি।’ সহায়তা পাঠানো অব্যাহত রাখার আহ্বান জানান তিনি। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আবদুলের পরিবারের সহায়তায় তিন হাজার মানুষ ৮০ হাজারের বেশি মার্কিন ডলার পাঠায়।
সহায়তা হিসেবে অর্থের অঙ্ক জানতে পেরে বিস্ময়ে মাটিতে বসে পড়েন আবদুল। কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। সাইমনাসন টুইটারে বলেন, তখন বার বার আমাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছিল আবদুল।’
আবদুল বলেন, তিনি এখন দুই সন্তানকে স্কুলে পাঠাতে পারবেন। অন্য শরণার্থীদেরও সহায়তা করতে চান তিনি।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক ব্যক্তি আরবিতে লিখেছেন, রিম ও তাঁর বাবার মুখে হাসি ফোঁটানোর জন্য সবাইকে ধন্যবাদ। এবার আমরা কিছু সম্ভব করেছি। এমন আরো মানুষকে সহায়তা করতে হবে।
সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধে কমপক্ষে দুই লাখ ২০ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। যুদ্ধ থেকে বাঁচতে ৪০ লাখের বেশি মানুষ পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন দেশে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছে।
0 comments: