মন্ত্রিসভার প্রভাবশালী মন্ত্রী ও দলে প্রভাবশালী নেতাদের কড়া সমালোচনা করলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২১ আগস্ট গ্রেনেডহামলা ও ২০০৭-এর ‘ওয়ান ইলেভেন’ পরবর্তী সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে দলের শীর্ষনেতাদের ‘হাসিনাবিরোধী’ অবস্থান নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, ‘আই ক্যান ফরগিভ বাট নেভার ফরগেট’।
গতকাল সোমবার সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভা বৈঠকের অনির্ধারিত আলোচনাকালে একথা বলেন বলে নিশ্চিত করেছেন সরকারের একজন মন্ত্রী।
বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বারবার আমাকে হত্যার উদ্দেশে হামলা করা হয়েছে। কিন্তু আল্লাহর রহমতে আমি এখনও বেঁচে আছি, সুস্থ আছি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ২১ আগস্ট গ্রেনেডহামলায় তারেক জিয়া সরাসরি জড়িত ছিল। তার নিয়ন্ত্রণে থাকা হাওয়া ভবনে আমাকে হত্যা মিশন সফল করার লক্ষ্যে একাধিক বৈঠক হয়েছে। কারা কারা সেসব বৈঠকে ছিল বা পরিকল্পনায় কারা কারা জড়িত তার অনেক কিছুই এখন আমি জানি।
শেখ হাসিনা এসময় হঠাৎই তারেক জিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশে অবস্থানরত তৎকালীন ভারতীয় রিসার্স অ্যান্ড এনালাইসিস উইং ‘র’-এর কতিপয় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নিয়ে কথা বলেন। তিনি মন্ত্রিসভায় জানান, সেসময় তারেক জিয়ার সঙ্গে ‘র’-এর একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। যেটা ছিল পারিবারিক পর্যায়ের। উদাহরণ হিসেবে প্রধানমন্ত্রী জানান, তারেক জিয়ার মেয়ের জন্মদিনে পারিবারিক অনুষ্ঠানের আমন্ত্রিত অতিথি ছিলেন ‘র’-এর বেশ কজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশে নেওয়া আরেক পরিকল্পনা সম্পর্কে এসময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, টুঙ্গিপাড়ায় পূর্ব নির্ধারিত একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার উদ্দেশে বাসা থেকে বের হওয়ার ঠিক পূর্বমুহূর্তে আমার হাতে একটি কাগজ আসে। যেটিতে লেখা ছিল- অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া ঠিক হবে না। আপনার জীবন সংকটাপূর্ণ। আর যদি বের হতেই হয়, অনুষ্ঠানে যোগ দিতে হয়- তাহলে বিশেষভাবে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেওয়া হয় তাতে।
এ ঘটনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সেসময় এরকম একটি কাগজ আমার হাতে আসার কথাছিল না। কিন্তু এসেছে। এটা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ি আমি। ভাবতে থাকি এটা কি ইচ্ছাকৃতভাবে আমার হাতে পৌঁছানো হয়েছে নাকি ভুলে কাগজটি আমার হাতে পৌঁছেছে। তিনি বলেন, যদি টুঙ্গিপাড়ায় বড় ধরনের কোনো ঘটনা ঘটতো বা সেখানে যদি আমি মারা যেতাম তাহলে বিএনপি সরকার জনগণের কাছে বলতে পারতো আমরাতো আগেই তাকে (শেখ হাসিনা) জানিয়েছিলাম। কিন্তু তিনি আমাদের কথা শোনেননি। অথবা এটি ভুল করেও আমার কাছে এসে থাকতে পারে। এভাবেই আমাকে বারবার গোপনে এবং কোনো কোনো সময় প্রকাশ্যে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে।
ওয়ান ইলেভেনের বিতর্কিত সরকার আমলে নিজ দলের শীর্ষ নেতাদের শেখ হাসিনার বিরোধিতা প্রসঙ্গে বলেন, সেসময় বাংলাদেশে নেতৃত্বের সংকট শুরু হয়। বিশেষ বিশেষ গোষ্ঠী ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’ বাস্তবায়নে উঠে পড়ে লাগে। যেভাবেই হোক মাইনাস টু ফর্মুলা বাস্তবায়ন করতে হবে। এতে অনেক নেতাই বিভ্রান্তিতে পড়ে যায়। আর এ সুয়োগটাই নেয় ষড়যন্ত্রকারীরা।
তিনি বলেন, এখানে উপস্থিত আমার মন্ত্রিসভার কয়েকজন সিনিয়র নেতাও সেসময় ওই ষড়যন্ত্রের পক্ষে সাড়া দেন। বর্তমান শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমদ, আওয়ামী লীগের সাবেক তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক অধ্যাপক আবু সাইয়্যিদ, সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মুকুল বোস, সাংগঠনিক সম্পাদক মান্নানসহ অনেকেই আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রেও লিপ্ত হন, আমাকে দল থেকে দেশ থেকে বহিষ্কার করার জন্য। কিন্তু তাদের এ ষড়যন্ত্রও সফল হয়নি। অথচ আমাকে মাইনাস করার জন্য আমার দলের শীর্ষ এসব নেতাও সেসময় ‘র’-এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষা করেন। এসব কথা আমার সব সময়ই মনে পড়ে। এজন্য ‘মে বি আই ক্যান ফরগিভ বাট নেভার ফরগেট’।
এ ব্যাপারে সরকারের প্রভাবশালী একজন মন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী যখন নাম ধরে ধরে সমালোচনা করছিলেন তখন মন্ত্রিপরিষদে উপস্থিত সদস্যরা মাথা নিচু করে চুপ করেছিলেন। মন্ত্রিসভার এ সদস্য আরও বলেন, আমি এবার প্রথম এ ধরনের অভিজ্ঞতা পেলাম। প্রধানমন্ত্রী যে চোখে চোখ রেখে এভাবে কারও সমালোচনা করতে পারেন এবং অপ্রিয় সত্য কথা বলতে পারেন- এটা এবারই আমি প্রথম দেখলাম।