বৃহস্পতিবার, ২৭ আগস্ট, ২০১৫

মাত্র বারো ঘণ্টার ব্যবধানে হাজারীবাগে দুই হত্যাকাণ্ড রহস্যে ঘেরা

বেলা সাড়ে তিনটায় মোবাইল চুরির অভিযোগে হত্যা করা হয় কিশোর রাজা মিয়াকে। রাত সাড়ে তিনটায় বন্দুকযুদ্ধে হত্যা করা হয় ছাত্রলীগ নেতা আরজু মিয়াকে। দু’জনেই রাজধানীর ট্যানারি শিল্প এলাকা হাজারিবাগের বাসিন্দা। প্রতিবেশীও। গত ১৭ আগস্ট এদের হত্যাকা- নিয়ে এখন চলছে আলোচনা সমালোচনা। মাত্র বার ঘণ্টার ব্যবধানে এ দুটো হত্যাকা-ের ঘটনায় হাজারিবাগে দেখা দিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। দু’পরিবারের অভিযোগও পরস্পরবিরোধী। বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। র‌্যাবকে অভিযুক্ত করে আদালতে নালিশ করেছেন আরজুর পরিবার। ইতোমধ্যে ওই এলাকার র‌্যাব সিও এসএম মাসুদ রানা ও হাজারিবাগ থানার ওসি মাইনুলকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। নিহত রাজা মিয়ার পরিবারের অভিযোগ-মোবাইল চুরির মতো একটা তুচ্ছ অজুহাতে মধ্যযুগীয় কায়দায় তাকে হত্যা করা হয়। বার বার তার বোন ছাত্রলীগ নেতা আরজুর পায়ে ধরে প্রাণ ভিক্ষা চাইলেও তাকে বিন্দুমাত্র দয়া দেখানো হয়নি। 
অন্যদিকে আরজুর পরিবারের অভিযোগ, রাজা মিয়া ওই রাতে তাদের বাসায় ঢুকে মোবাইল ও ল্যাপটপ চুরি করে নিয়েছে। সে জন্য তাদের বাসার সামনে এনে মহল্লাবাসী গণপিটুনি দিয়ে তাকে হত্যা করেছে। তারপর সাদা পোশাকে র‌্যাব এসে আরজুকে ধরে নিয়ে তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধে হত্যা করেছে। 
দুই পরিবারের পরস্পরবিরোধী এ সব অভিযোগ কতটা সত্যা মিথ্যা এবং প্রকৃত অর্থেই সে দিন কি ঘটেছিল তা জানতে গত সোম ও মঙ্গলবার পর পর দু’দিন হাজারিবাগে সরেজমিনে পরিদর্শনে যান এ প্রতিনিধি। এ সময় দু’পরিবার ছাড়াও স্থানীয় ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, পুলিশ ও সাধারণ নিরীহ মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় এ দুটো হত্যাকা-ের নেপথ্য কাহিনী। 
হাজারিবাগ মনেশ্বর রোডের বটতলার এক দোকানদার জানান, তিনি দীর্ঘদিন ধরেই এ এলাকায় বসবাস করছেন। এ দুটো হত্যাকা-ের ঘটনায় সাধারণ মানুষের মাঝে কোন প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীরা প্রথম দু’দিন প্রতিবাদ ও হৈচৈ করলেও এখন সেটাও থেমে গেছে। হাজারীবাগ থানার ওসি মাইনুল ইসলাম ও র‌্যাব সিও মাসুদকে প্রত্যাহারের পর সবাই চুপসে গেছে। এমনকি স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগেরও একটা অংশ এ নিয়ে আর বাড়াবাড়ি করার পক্ষপাতি নয়। 
তবে আরজুর প্রতিবেশী, গণকটুলি এলাকার একজন বাসিন্দার প্রশ্ন, ‘কমিশনারের অফিস থেকে আরজু মিয়াকে সাদা পোশাকের লোকজন ডেকে নিয়ে হোন্ডায় তুলে নিয়ে গেল। অথচ স্থানীয় সাংসদকে একজন নেতাকর্মীও এ খবরটা দেয়নি। বরং আরজুর ভাই মাসুদ রানা বার বার যখন স্থানীয় কমিশনার সজীবসহ অন্য নেতৃৃবৃন্দের কাছে জানতে চান-কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে তাকে তখন তাকে সবাই নিশ্চিত করেন, আরজু সেইফে আছেন। তার কোন ক্ষতি হবে না।’
সন্ধ্যা থেকে সারা রাত এমন নিশ্চয়তাই দিয়েছেন স্থানীয় নেতৃবৃন্দ অথচ সকালে শিকদার মেডিক্যালের পেছনে তার গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া যায়। এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না তার ভাই মাসুদ রানা। 
মঙ্গলবার জনকণ্ঠকে চরম বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, ‘আরজুকে ধরে নেয়ার পর স্থানীয় কমিশনার সজীব, ওয়াকিব, তুহিন, মারুফ ও মনিরসহ ক্ষমতাসীন দলের অন্তত সাতজন নেতাকে ফোন করি। তারা সবাই জোর দিয়ে নিশ্চিত করেন আরজু সেইফে আছেন। তার কিছুই হবে না। সকালে যখন ভাইয়ের লাশ দেখি তখন বুঝতে পারি ওরা সবাই কেন এক সুরে কথা বলছে। ওদের চোখের সামনে থেকে আরজুকে ধরে নিয়ে গেল, অথচ তারা তাকে বাঁচানোর জন্য কিছুই করেননি। ওরা যদি এমপি তাপস ভাইকে তাৎক্ষণিক ফোন করে জানাত, বাঁচানোর অনুরোধ করত, তাহলে র‌্যাব এই সাহস করত না। আমার ভাইও মরত না। এটাই আমাদের দুঃখ।’
মাসুদ রানার ক্ষোভ প্রকাশে এটা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতৃত্বের সঙ্গে রেষারেষি, হিংসা ও প্রতিহিংসার সম্পর্ক ছিল আরজুর। স্থানীয় রাজনীতিতে কয়েকজনকে ডিঙ্গিয়ে বেশ খানিকটা এগিয়ে যাওয়া আরজু মিয়ার সাম্প্রতিক কিছু কর্মকা-ে স্থানীয় থানা পুলিশও ছিল তার প্রতি বেশ ক্ষুব্ধ। এগুলোর মধ্যে ছিল- মাস খানেক আগে এক রাতে মহল্লার এক দোকানে হাজারীবাগ থানার একজন দারোগাকে লাঞ্ছিত করা, ডিশ ও টেম্পো ব্যবসায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষের রোষানলে পড়া।
এ সম্পর্কে জানতে চাইলে স্থানীয় আওয়ামী লীগ দলীয় ওয়ার্ড কমিশনার তারিকুল ইসলাম সজীব জনকণ্ঠকে বলেন, আরজু হত্যাকা- এখানকার রাজনীতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক। স্থানীয় সংসদ সদস্য তাপস ভাইয়ের হাতে গড়া এই নেতার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ ছিল না। হাজারিবাগ থানায় তার নামে কোন মামলা বা জিডিও ছিল না। ক্লিন ইমেজ থাকার কারণেই তাকে ছাত্রলীগের সভাপতি করা হয়। এবার আরজু এম এ পরীক্ষার্থী ছিলেন। তার পরীক্ষার ফিটাও আমি দিয়েছি। সে যদি চাঁদাবাজ হতো তাহলে তো টাকার অভাব হতো না। আসলে তিনি পুলিশের রোষানলের শিকার হয়েছেন। কারণ পুলিশের অনেক অবৈধ কাজে আরজু বাধা দিতেন সেজন্যই তাকে সহ্য করতে পারেননি ওসি মাইনুল। 
আরজুকে ধরে নেয়ার খবর আপনারা তাৎক্ষণিক সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপসকে জানাননি কেন প্রশ্ন করা হলে সজীব বলেন, ‘আমার ফোনে চার্জ ছিল না। সকালে যখন তাপস ভাইয়ের সঙ্গে কথা হয় তখন তিনিও স্বীকার করেন- রাতে কেউ তাকে জানায়নি। জানালে হয়ত তিনি একটা কিছু করতেন। 
এ দিকে আরজুর বিষয়ে জানতে চাইলে হাজারিবাগ থানার একাধিক দারগা জনকণ্ঠের কাছে পাল্টা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে বিএনপি জামায়াত দেশব্যাপী যে নাশকতার তা-ব চালিয়েছিল, সে সময় মাঠে কোন ছাত্রলীগ, যুবলীগ বা আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ছিল না। ওই সময় একমাত্র পুলিশ, র‌্যাব ও বিডিআর জীবন বাজি রেখে বর্তমান সরকারকে রক্ষা করে। সেটা করতে গিয়ে সারাদেশে পুিলশের শতাধিক লোক প্রাণ হারায়। এখনও পঙ্গুত্বের অভিশাপ নিয়ে বেঁচে আছেন অনেকেই। কিন্তু এই পুলিশ এখন ছাত্রলীগ ও যুবলীগের হাতে মার খাবে, লাঞ্ছনার শিকার হবে, অপমানিত হবে এটা কিছুতেই বরদাশত করার মতো নয়। এই আরজু থানায় এসে ওসির সঙ্গে দুর্ব্যবহার করত। রাতের আঁধারে কর্তব্যরত পুলিশ অফিসার শাহজাহানকে আরজু ও তার লোকজন লাঞ্ছিত করেছে। 
এদিকে নিহত কিশোর রাজা মিয়ার বড় বোন শাবানা জনকণ্ঠকে জানান, তুচ্ছ একটা মোবাইল ফোন সেট চুরির অভিযোগে তাকে বাসার সামনে থেকে ধরে নিয়ে আরজুর বাসায় আটক রাখা হয়। ওখানে উপস্থিত ছিল আরজুর ক্যাডার মনির, সাগর, এসকে বাবু, সুজনসহ আরও অনেকে। আরজুর মাও সেখানেই ছিলেন। সেখানে তাকে চরম অমানুষিক নির্যাতন করা হয় যাতে সে চুরির কথা স্বীকার করে। কিন্তু রাজা কখনই তা স্বীকার করেনি। তখন দৌড়ে আমি আরজুর বাসায় গিয়ে দেখি তাকে বেঁধে রাখা হয়েছে। সারা শরীরে মারের আঘাত। এ সময় লোহার খুন্তি গরম করা হয় তার শরীরে ছ্যাকা দেয়ার জন্য। আমি তখন আরজু ও তার মায়ের পায়ে পড়ে রাজার প্রাণভিক্ষা চাই। তখন ওকে বাসা থেকে বের করে তারা বাড্ডানগরের নির্মাণাধীন একটি ভবনের দিকে নিয়ে যায়। আমি তার পিছু যেতে থাকলে তখন আরজু আমাকে বলেন, আপনি চলে যান। আমরা তাকে আর মারব না। শুধু জিজ্ঞাসা করে ছেড়ে দেব। সে যদি মোবাইল চুরির কথা স্বীকার করে তাহলে আর মারব না। 
আরজুর মুখে এমন কথা শুনে আমি চলে আসি। তারপর বিকেল চারটায় শুনি ওরা ওই ভবনে মারতে মারতে রাজাকে অজ্ঞান করে ফেলে। পরে তাকে হাসপাতালে নেয়া হলে ডাক্তার মৃত ঘোষণা করেন। 
শাবানার প্রশ্নÑ রাজা যদি চুরিই করত তাহলে কি সে এত মার খাওয়ার পরও স্বীকার করত না। ওরা যখন তাকে আমার চাচা ও ফুফুর সামনেই মারতে থাকে তখনও আমি ওদের বলেছি তোমরা তাকে এভাবে মের না। ওকে পুলিশে দিয়ে দাও। পুলিশ তদন্ত করে দেখুক। শাস্তি দিক। ওরা আমাদের ধোঁকা দিয়ে নিয়ে গেল নির্মাণধীন ভবনে- যা আরজুর রিমান্ড ঘর নামে পরিচিত। কিন্তু পরে তো আরজুকে মরতে হলো বন্দুকযুদ্ধে। আর এটাই হচ্ছে আল্লাহর বিচার। আমরা তো এ বিচার করতে পারতাম না। আল্লাহ একজন আছেন। তিনিও এমন নির্যাতন সহ্য করেননি, বলেই বিচারটা নগদ করেছেন। 
মঙ্গলবার রাজা মিয়ার বাসায় গিয়ে দেখা যায়, গণকটুলির এক গলির ভেতর একতলা ছোট একটা বাসায় তার পরিবারের বসবাস। মা নেই। বাবা বাবুল মিয়া পাশের একটি মার্কেটে নাইটগার্ডের কাজ করেন। রাজা এখানেও থাকত না। সে খলামোড়া বড় বোনের বাসায় থেকে স্টিলের কাজ করত। মাঝে মাঝে এখানে বেড়াতে আসত। যেদিন তাকে হত্যা করা হলো সেদিন বিকেলেই তার খলামোড়া ফিরে যাবার কথা ছিল। 
এ সময় রাজা মিয়ার বাবা বলেন, ‘ঘটনার আগের দিন আমি চোখের অপারেশন করাতে মিটফোর্ড হাসপাতালে ভর্তি হই। মারা যাবার পরদিন আসি। তারপর সন্তানের লাশ, হাসপাতাল, থানা পুলিশ নিয়ে সবাইকে পেরেশানিতে থাকতে হয়। 
তিনি আরজুর এহেন নৃশংসতায় চরম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ক্ষমতার জোরে এমন ঘটনা ঘটাল। তার বিরুদ্ধে তো অভিযোগের শেষ নেই। 
এ সব অভিযোগ অস্বীকার করে আরজুর ভাই মাসুদ রানা জনকণ্ঠকে বলেন, ঘটনার আগের রাত তিনটার সময় রাজা মিয়া চুরির উদ্দেশ্যে এই বাসার জানালা দিয়ে উঁকি দেয়। আরজু তখন শুয়ে ছিল। সকালে উঠে দেখে তার রুম থেকে চারটা মোবাইল ফোন ও একটা ল্যাপটপ চুরি হয়ে গেছে। এটা আসলে রাজা মিয়াই করেছে। বাসার কেচি গেট লাগানো থাকলেও রাজা মিয়া পাশের ছাদ দিয়ে ভেতরে ঢুকে এগুলো নিয়ে গেছে। 
এ জন্য তাকে মেরে ফেলতে হবে এমন প্রশ্ন করা হলে মাসুদ রানা বলেন, তাকে তো আরজু মারেনি। রাজা মিয়ার চাচা শামীমই তাকে ধরে আনে। এ সময় আরজুর দলের কর্মীরা অতি উৎসাহে এগিয়ে এসে নিজেরাই মারতে থাকে। আসলে আরজুকে খুশি করার জন্যই মহল্লার কয়েকজন কর্মী এমন ঘটনা ঘটায়। তারাই তাকে মারে। পরে নিয়ে যাওয়া হয় অন্যত্র। সেখান থেকে হাসপাতালে। সেখানেই মারা যায়। 
রাজা মিয়া আসলেই চোর ছিল কি না মহল্লার কোন লোকজন সে বিষয়েও তেমনটা অবগত নয় বলে জানান। 
এ সব বিষয়ে জানতে চাইলে ওসি মাইনুল ইসলাম বলেন, আরজু কি করেছে তা থানার রেকর্ডেই আছ্। এ নিয়ে আর কথা বলার দরকার নেই।

SHARE THIS

Author:

Etiam at libero iaculis, mollis justo non, blandit augue. Vestibulum sit amet sodales est, a lacinia ex. Suspendisse vel enim sagittis, volutpat sem eget, condimentum sem.

0 comments: