শুক্রবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

বাংলাদেশেই সহজেই ক্যান্সার নিরাময় উদ্ভাবন

ক্যান্সার নির্ণয়ে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ রেখেছেন বাংলাদেশের গবেষকরা। তারা এমন এক পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন যা বিশ্বজুড়ে চিকিত্সকদের অবাক করে দিয়েছে। অত্যন্ত সহজ পদ্ধতি এবং খুব কম খরচে তারা ব্রেস্ট ক্যান্সার নির্ণয়ে ইলাস্টোগ্রাফির এ পন্থাটি চিকিত্সকদের অবাক করেছে। স্বনামধন্য চিকিত্সকরা বলছেন, এটা কার্যকর এবং তাদের পুরনো ধারণাকে বদলাতে তারা দ্বিধা করছেন না। প্রাথমিকভাবে স্তন ক্যান্সার নির্ণয়ে প্রচলিত পদ্ধতির চাইতে অত্যন্ত কার্যকরী পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন একদল বিজ্ঞানী। সরকারি অর্থায়নে দুই বছরের গবেষণায় এই আবিষ্কার করেছেন তারা। ইলাস্টোগ্রাফি বিশ্বজুড়ে নতুন রোগ নির্ণয় পদ্ধতি হিসাবে উঠে আসছে। এই ইলাস্টোগ্রাফিকে ব্যবহার করে প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যান্সার নির্ণয়ে সাফল্য পেয়েছেন তারা। বিশ্বজুড়ে স্তন ক্যান্সার নারীদের এক নীরব ঘাতক। বিশ্বব্যাপী ক্যান্সারে নারী মৃত্যু সবচেয়ে বেশি হয় স্তন ক্যান্সারে। বাংলাদেশে নারীর মুত্যুর প্রধান পাঁচটি কারণের মধ্যে একটি স্তন ক্যান্সার।

তবে এ গবেষণা দলের মূল ব্যক্তির নাম শুনলে সবাই হোঁচট খাবেন। তিনি কিন্তু কোন চিকিত্সক নন। তিনি একজন প্রকৌশলী। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল এন্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের একজন অধ্যাপক। নাম মোঃ কামরুল হাসান।

‘আমি প্রকৌশলী বলে প্রথমে সবাই একটু ভুরু কুঁচকিয়েছিল।’ নিজেদের আবিষ্কারের কাহিনী বর্ণনা করছিলেন ড. মোঃ কামরুল হাসান। ‘আমাদের প্রজেক্ট যখন সম্পন্ন হলো তখন প্রথম যে রোগী এলেন তিনি একজন স্বনামধন্য চিকিত্সকের আত্মীয়া। স্তনের আলট্রাসনোগ্রাম রিপোর্ট দেখে যে চিকিত্সকরা প্রথমে টিবি হিসাবে ধারণা করেছিলেন। অন্য চিকিত্সকরা রিপোর্ট দেখে বললেন, তিন সপ্তাহের ওষুধ দিয়ে দিন ভালো হয়ে যাবে। কিন্তু সেই স্বনামধন্য চিকিত্সক আমাদের প্রজেক্টের কথা জানতেন, তিনি আমাদের কাছে পাঠালেন। আমরা পরীক্ষা করে বললাম এটা টিউমার, ম্যালিগন্যান্ট। কিন্তু আমাদের কথাকে কেউ পাত্তা দিলেন না।

তিনি বললেন, ইঞ্জিনিয়াররা ডাক্তারির কী বোঝেন?’ বলে মিটমিট করে হাসলেন অধ্যাপক। বললেন, আমরা আসলে ডাক্তারি করছি না, আমাদের আবিষ্কারটা সিম্পল ফিজিক্স। পরে সেই রোগীকে অপারেশনের আগে দ্রুত রিপোর্ট পাওয়ার জন্য বিশেষ ব্যবস্থায় বায়োপসির ব্যবস্থা করা হয়। আমাদের রিপোর্ট ঠিক ছিল। আলট্রাসনোগ্রাম ও ম্যামোগ্রাফির রিপোর্ট পরিষ্কার তথ্য দেয়নি। কিন্ত আমাদের ইলাস্টোগ্রাফি খুব ভালো তথ্য দিচ্ছে। শুধু তাই না, ব্রেস্ট ক্যান্সার নির্ণয়ের এখন সবচেয়ে ভালো পরীক্ষা হচ্ছে ম্যামোগ্রাফি। এই ম্যামোগ্রাফিতে ৪৫ বছরের বেশি কোন নারীর প্রাথমিক পর্যায়ের টিউমার থাকলে তা নির্ণয় সম্ভব। কিন্তু অল্প বয়সের কোন নারীর সেটা সম্ভব হবে না। কিন্তু ইলাস্টোগ্রাফিতে এটা আমরা ১৩ বছর বয়সী মেয়ের শরীরেও টিউমার শনাক্ত করতে পেরেছি।

কার্যকরি ও সহজ নির্ণয় পদ্ধতি

বিষয়টা খুব সাধারণ। একটা সাধারণ রিডিং নেয়া হচ্ছে আলট্রা সাউন্ড যেভাবে নেয়া হয়। আলট্রা সাউন্ডে যেভাবে জেল মাখিয়ে রিডিং নেয়া হয় আর কি। কোন প্রেশার ছাড়াই স্তনের একটা আলট্রা সাউন্ড রিডিং নেয়া হচ্ছে। এরপর হালকা একটু চাপ দিয়ে আরেকটা রিডিং নেয়া হচ্ছে। এরপর আমাদের বিশেষ যন্ত্রে সেই রিডিংটাকে বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। এখন যদি কোন লাম্প থাকে তবে সেই জায়গাটার টিস্যু শক্ত থাকবে। চাপে স্বাভাবিক সংকোচন হবে না। আমরা এই রিডিংটা নিচ্ছি। সেইসময় আাাশেপাশের টিস্যুর প্রকৃতি, লাম্পের আকৃতি, ভেতরে কোন পুঁজ আছে কিনা, ম্যালিগন্যান্ট কি না এসব কিছুর ডিটেইল একটা চিত্র পাওয়া যাচ্ছে। সেই রিডিংটাকে বিশ্লেষণ করতে হবে। এই বিশ্লেষণী পর্যায়টা খুব গভীর ও অভিজ্ঞ চিকিত্সককে করতে হবে। সাধারণ আলট্রা সাউন্ড টিস্যুও ‘এটিনিউশন’ ইমেজিং করে। এতে টিউমার ও ব্যাক গ্রাউন্ডের ‘এটিনিউশন’ কাছাকাছি হয়। তখন এটা বোঝা যায় না। কিন্তু ‘ইলাস্টোগ্রাম’ শক্ত স্থানকে শনাক্ত করে। তবে ইলাস্টোগ্রাফির ফলাফল থেকে এককভাবে নির্ণয়ের চাইতে আলট্রা সাউন্ড রিপোর্টকে সমন্বয় করে এ ফলাফল দেয়া হলে শনাক্তকরণের হার বেশি সঠিক হয় বলেও জানান ড. কামরুল হাসান।

প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যান্সার শনাক্তকরণের এমন সহজ ও কার্যকর পদ্ধতি উদ্ভাবন বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তুলেছে। বুয়েট এ গবেষণাকে স্বীকৃতি তো দিয়েছেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিখ্যাত মেডিক্যাল জার্নালগুলোতে এ বিষয়ে এটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে— আলট্রা সাউন্ড ইন মেডিসিন অ্যান্ড বায়োলজি জার্নালে প্রকাশিত ‘বাইমডাল মাল্টিপ্যারামিটার-বেইজড অ্যাপ্রোচ ফর বেনাইন-ম্যালিগন্যান্ট ক্লাসিফিকেশন অব ব্রেস্ট টিউমারস’।

কেন এই আবিষ্কার পদ্ধতি গুরুত্বপূর্ণ

বিশ্বজুড়েই ইলাস্টোগ্রাম নিয়ে কাজ চলছে। ক্যান্সার নির্ণয়ে জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়েও গবেষণা হচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশেও গবেষণাটা খুব কম খরচে করা সম্ভব হচ্ছে। এছাড়া জটিলতা কম ও দ্রুত ফলাফল দেয়। সে কারণে বিশ্বজুড়েই ইলাস্টোগ্রাম পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে।

কামরুল হাসান জানালেন, বুয়েট মেডিক্যাল সেন্টারে আমাদের ইউনিটটি বসানো রয়েছে। কিন্তু সেখানে এত রোগীর চাপ সামলানো মুশকিল। এ পর্যন্ত আমরা ৩৪৫ রোগীর টেস্ট করেছি এবং নিশ্চিতভাবে ১০ জন মনুষের জীবন বাঁচিয়েছি প্রাথমিক পর্যায়ে ব্রেস্ট ক্যান্সার শনাক্ত করে। আমাদের সাফল্যের হার খুব ভালো। এখন বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে রোগীর চাপ আসছে। আমাদের বিশেষ এই ইউনিটটি ক্রিটিক্যাল রোগীদের ক্ষেত্রেই শুধু সেবা দিতে পারছে। তবে বাংলাদেশে এই পদ্ধতিকে মেডিক্যাল কলেজগুলোতে পাঠ্য হিসাবে দেয়ার সুপারিশ করলেন তিনি। বললেন, এখন যারা চিকিত্সক, তাদের পর্যায়ক্রমে প্রশিক্ষণ দেয়া যেতে পারে। তবে ব্রেস্ট ক্যান্সার নির্ণয়ে ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টার স্থাপনের প্রয়োজনয়ীতা উল্লেখ করেন তিনি।

বিশ্বব্যাপী মেয়েদের যত ক্যান্সার হয় তার ২৩ ভাগই স্তন ক্যান্সার। প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী প্রায় ২২ হাজার নারী স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে ৭০ ভাগই মারা যায়। কিন্তু এ ক্যান্সারে আক্রান্ত হলেই যে মৃত্যু নিশ্চিত, তা কিন্তু নয়। এ ক্যান্সারে বেঁচে যাওয়ার হার প্রায় ৮৫ ভাগ। আমাদের দেশে এ ক্যান্সার দেরিতে নির্ণয় হয় বলে মৃত্যুহার বেশি। কিন্তু সূচনায় চিহ্নিত করতে পারলে এ রোগ নিরাময় করা সম্ভব।

যারা জড়িত এ গবেষণায়

বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের হায়ার এডুকেশন কোয়ালিটি এনহ্যান্সমেন্ট প্রজেক্টের (হেকেপ) অধীনে প্রজেক্ট ছিল। ২০১১ সালের পহেলা জানুয়ারি থেকে ২০১২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত চলে এ গবেষণা। এ গবেষণা দলের প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট টিমের টিম লিডার হচ্ছেন ড. কামরুল হাসান। ইঞ্জিনিয়ারিং টিমের অন্য সদস্যরা হলেন- ড. এম আই হাসান ভুইয়া, ড. মোঃ আরিফুল হক ও ড. এস এম মাহবুবুর রহমান। চিকিত্সক দলের সদস্যরা হলেন- ডা. রায়হানা আওয়াল, ডা. ফারজানা আলম ও ডা. শারমিন আখতার।  এতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল ১ লাখ ২১ হাজার ডলার। তারা তুলেছিলেন ১ লাখ ১৯ হাজার ডলার। তবে প্রজেক্ট শেষে ৫ হাজার ৬০০ ডলার ফেরত দেন তারা।

অধ্যাপক কামরুল হাসান জানালেন, এ ধরনের গবেষণার জন্য টাকা পাওয়াটা খুব কঠিন। তেমনি কঠিন গবেষণার ভালো পরিবেশ পাওয়া। তবে আমরা ভাগ্যবান যে এই ফান্ডটা পেয়েছিলাম।

এ প্রসঙ্গে প্রকল্প পরিচালক হায়ার এডুকেশন কোয়ালিটি এনহ্যান্সমেন্ট প্রজেক্টের (হেকেপ) ড. গৌরাঙ্গ চন্দ্র মোহান্ত বলেন, এই প্রকল্পের অধীনে অনেক উদ্ভাবনমূলক কাজ হচ্ছে। দেশের শিক্ষাগত উন্নয়ন, গবেষণামূলক কাজকে গুরুত্ব দিচ্ছি আমরা। এই প্রকল্পের অর্জন আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে। এমনকি বিশ্বব্যাংকও আমাদের গবেষণার সাফল্য দেখে এ বিষয়ে আরো অর্থায়নে আগ্রহ দেখিয়েছে যা দেশের গবেষকদের গবেষণার ক্ষেত্রকে প্রসারিত করবে।



SHARE THIS

Author:

Etiam at libero iaculis, mollis justo non, blandit augue. Vestibulum sit amet sodales est, a lacinia ex. Suspendisse vel enim sagittis, volutpat sem eget, condimentum sem.

0 comments: